এখন বর্ষাকাল৷ কৃষক/বাগান-বিলাসীরা বগিচা রচনায় হাত দিয়েছেন। বর্ষার মরশুমেই বাগান রচনা করার আদর্শ সময়। চাষে আয় বাড়াতে ফলের বাগান করা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ, ঝামেলাও কম। সেই বাগানে প্রথম আট-দশ বছর নানান সাথী ফসল চাষ করা সম্ভব হবে, যা আপনি আগেও চাষ করছিলেন। এরই মাঝে ধীরেধীরে তৈরি হয়ে যাবে এক সুন্দর ফলের বাগান। প্রস্তুত নিবন্ধে আলোচিত হয়েছে আমগাছের বাগান রচনা করতে হলে কী দূরত্বে চারা বসাতে হবে, কীভাবে বসাতে হবে, বৃক্ষ-সৌধ রচনাই বা এরফলে কীভাবে হবে।
প্রথমে জেনে নিই, আম গাছ রোপণ করতে হলে গর্ত কীভাবে করতে হবে?
সাধারণভাবে গ্রীষ্মের সময় ২x২x২ ফুট মাপের গর্ত খুঁড়ে রাখতে হবে। গর্তের মাটি তুলে পাশে রেখে দিতে হবে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক পেয়ে তাতে রয়ে যাওয়া রোগজীবাণু ও পোকা-মাকড় সব মরে যায়। এরপর প্রতিটি গর্তে ১/২ ঝুড়ি ভালোভাবে পচানো গোবর বা অন্যান্য জৈব সার এবং ৫০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং খানিকটা মাটি মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ভরাট হবার পর তা কয়েকদিন ফেলে রাখলে গর্তের মাটি বসে যায়। এবার সুবিধামত দিনে বর্ষার প্রথমে বাগানে আমের চারা বসানো উচিত।
সুস্থ ও সবল চারা লাগাতে হয়। চারা বসানোর সময় গাছের অপ্রয়োজনীয় বা মরা ডালপালা থাকলে তা হাল্কা করে ছেঁটে ছত্রাকনাশকের পেস্ট লাগিয়ে দিতে হবে। চারাগাছটি গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে সাবধানে বসাতে হবে। পলিথিন ব্যাগে চারা থাকলে পলিথিন ছুরিতে কেটো সরিয়ে এমনভাবে বসাতে হবে যেন মাটির বলটি অক্ষত থাকে। মাটির বলটির স্তর এবং জমির মাটি যেন একই সমতলে থাকে। গাছ লাগানোর পর মাটি এমনভাবে চারপাশে চেপে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন কোথাও অকারণে গর্ত হয়ে জল জমে গাছের ক্ষতি না হয়।
আম গাছে কী দূরত্ব দেবেন?
সাধারণ জাতগুলি (হিমসাগর, ল্যাঙ্গড়া, বোম্বাই, ফজলি) ১০x১০ মিটার, বেঁটে জাতে (আম্রপালি, মঞ্জিরা, বেঁটে বারোমাসি) ৫x৫ মিটার, মাঝারি বেঁটে থেকে মাঝারি জাত যেমন মল্লিকার স্পেসিং ৭.৫x৭.৫ মিটার দিতে পারেন। এটিকে বর্গাকার বা স্কোয়ার সিস্টেম বলে। স্কোয়ার সিস্টেমে ৩০ মিটার x ৩০মিটার বর্গাকার জমিতে ৯ টি হিমসাগর বা ল্যাংড়া গাছ লাগানো যায়। এই হিসাবে এক হেক্টর জমিতে
স্কোয়ার সিস্টেমের প্রতিটি স্কোয়ারের মাঝে যদি সাথী ফসল হিসাবে একটি অনুচ্চ গাছ লেবু, পেয়ারা বা অন্য কোনো ফলের গাছ লাগিয়ে স্থানটিকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করে নিতে হয়, সেই পদ্ধতিতে রোপণের নাম কুইনকান্স সিস্টেম (Quincunx System) বা পঞ্চম-অন্তস্থল বা পঞ্চমস্থল পদ্ধতি। বর্গাকার বা আয়তাকার পদ্ধতির দুই কল্পিত কর্ণের ছেদবিন্দুতে অতিরিক্ত একটি গাছ লাগানোর পদ্ধতির নামই কুইনকান্স। গাছের সংখ্যা বাড়লেও অনেকসময় যান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে, ট্র্যাক্টর/ পাওয়ার টিলার চালাতে, মেকানিকাল হার্বেস্টার ব্যবহার করতে অসুবিধা হতে পারে এই পদ্ধতি। তবে দূরত্ব যদি এমন হয়, এইসব যন্ত্রপাতি চালাতে অসুবিধা না ঘটায়, তবে গাছের সংখ্যা বাড়িয়ে অতিরিক্ত আয় সম্ভব।
তবে ঘন করে গাছ লাগিয়ে বাগান থেকে বেশি আয় করতে গেলে দ্বি-বেড়া সারি (Double hedge row system) অনুসরণ করা দরকার। ৫x৫ মিটার দূরত্বে দুটি সারি, মাঝে ১০ মিটার ছাড়, তারপর ফের ৫x৫ মিটার দূরত্ব। এইভাবে গাছ লাগালে প্রতি হেক্টরে (সাড়ে সাত বিঘে) ১০০ টার বদলে ২২২ টি গাছ লাগানো যাবে। অতি ঘন করে আম্রপালি গাছও ২.৫x২.৫ — ৫– ২.৫x২.৫ এই রকম দ্বি-বেড়া সারি করে লাগানো যায়। তবে মাঝেমধ্যে ফলন নেবার পরপরই কিছু ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে যাতে দুটি গাছের মধ্যে স্বাভাবিক আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে। একটু নীচু জমিতে মাদা করে মাটি ফেলে সামান্য উঁচুতে গাছ লাগানো সম্ভব হয়। মালদা-মুর্শিদাবাদ-হুগলি নানান জেলায় ধানের জমিতেও মাদা করে উঁচু ঢিপি বানিয়ে আমগাছ লাগানোর চল আছে। কোথাও এই ঢিপির উচ্চতা দুই/তিন ফুট, ব্যাস প্রায় চার ফুট।
আমবাগান তৈরির জন্য দ্বি-বেড়া সারি (ঘন করে লাগানোর জন্য সব চাইতে ভালো পদ্ধতি বলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে প্রমাণিত হয়েছে) ছাড়াও অন্যান্য প্ল্যান্টিং সিস্টেম অনুসরণ করা যায়। যেমন বেড়া সারি (Hedge row sysyem)। এই পদ্ধতিতে দু’টি সারির মধ্যে স্বাভাবিক দূরত্ব (জাতভেদে ১০ মিটার/৭.৫ মিটার/বা ৫ মিটার) থাকলেও, নির্দিষ্ট সারির মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে অর্ধেক করা হয়। স্কোয়ার সিস্টেমে ৩০ মিটার x ৩০ মিটার বর্গাকার জমিতে ৯ টি গাছ লাগানো গেলে, বেড়া সারি পদ্ধতিতে ১৫ টি গাছ রোপণ করার সুযোগ থাকে।
আর একটি পদ্ধতির নাম পেয়ার্ড প্ল্যান্টিং (Paired Planting) বা যুগ্ম-রোপণ। এক একটি জোড়া গাছ পাশাপাশি লাগানো হবে প্রচলিত দূরত্বের অর্ধেক দূরত্ব রেখে। একটি জোড়া থেকে অপর জোড়ার মাঝে সবসময় স্বাভাবিক দূরত্ব দিতে হবে। স্কোয়ার সিস্টেমে ৩০ মিটার x ৩০ মিটার বর্গাকার জমিতে ৯ টি গাছ লাগানো গেলে, পেয়ার্ড প্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে ১২ টি গাছ রোপণ করার সুযোগ থাকে।
ষষ্ঠ একটি পদ্ধতির নাম ক্লাস্টার প্ল্যান্টিং (Cluster planting) বা গুচ্ছ রোপণ পদ্ধতি। এখানে স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রেখে চারটি গাছের এক একটি ক্লাস্টার রচিত হয়। প্রতিটি ক্লাস্টারের মধ্যে চারটি গাছের ভেতরে দূরত্ব কমিয়ে অর্ধেক করা হয়। অর্থাৎ ক্লাস্টার পদ্ধতিতে হিমসাগর/ল্যাংড়া জাতে ১০ মিটার দূরে দূরে এক-একটি ক্লাস্টারে ৫ মিটার দূরত্ব দিয়ে চারটি গাছের একটি বর্গাকার প্লট রচিত হবে। স্কোয়ার সিস্টেমে ৩০ মিটার x ৩০মিটার বর্গাকার জমিতে ৯ টি গাছ লাগানো গেলে, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে ১৬ টি গাছ রোপণ করার সুযোগ থাকে।
ক্যানোপি ম্যানেজমেন্ট:
ফল উৎপাদনের প্রাথমিক শর্ত হল আলোক সান্নিধ্য। ক্যানোপি ম্যানেজমেন্ট বা গাছের উপযুক্ত অঙ্গবিস্তার ব্যবস্থাপনায় ফলনবৃদ্ধি হয়। ফলগাছের উৎপাদন ক্ষমতা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, তার মধ্যে পল্লব-সৌধ (Canopy Architecture) নির্মাণে, রক্ষণাবেক্ষণে বা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ঘটলে তা বেশ সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে। ফলন বাড়ানোর জন্য যথোপযুক্ত পল্লব-সৌধ নির্মাণ, ডালপালার ঘনত্ব (Canopy Density) বজায় রাখা এবং সবুজ অঙ্গের সালোকসংশ্লেষীয় পারদর্শিতা (Photosynthetic efficiency) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। একটি গাছের ক্যানোপি বা অঙ্গবিস্তার বলতে বুঝি তার প্রাকৃতিক বা ভৌত উপাদান (Physical composition), যা দিয়ে তৈরি হয় তার মূল কাণ্ড, শাখা, বিটপ ও পাতা। অঙ্গবিস্তারের ঘনত্ব (Canopy Density) নির্ণীত হয় তার কাণ্ড, শাখাপ্রশাখা এবং বিটপের সংখ্যা, দৈর্ঘ্য ও তাদের বিন্যাস (Orientation) -এর উপর। আমের বিভিন্ন জাতে অঙ্গবিস্তারে তফাৎ থাকে বলেই দূরত্ব আলাদা রকম দিতে হয়৷ অঙ্গবিস্তার ব্যবস্থাপনা বিশেষত তার আকৃতি নিয়ন্ত্রণ বাগানীদের কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে। কারণ এতে উৎপাদন খরচ কমানো যায়, উৎপাদন বেশি হয় এবং পণ্যের উৎকর্ষতা বাড়ে।
অঙ্গবিস্তারণের উদ্দেশ্যগুলি হল গাছের পক্ষে সর্বাধিক সূর্যালোক গ্রহণ সম্ভব করে তোলা। বাগিচায় মডেল-গাছ এমন আকার বা ফর্মে থাকবে, যাতে গাছ সর্বোত্তম সূর্যালোক গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। তখনই তা সম্ভব হবে যখন গাছকে ছাঁটাই করে (Pruning), কায়াদান করে (Training), শাখার বিন্যাসকরণের মাধ্যমে, অঙ্গবিস্তারের নকশা (Canopy Design) ও আকার পরিবর্তনের মাধ্যমে আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া যায়। বলা হয়, গাছের উলম্ব প্রসারণের চাইতে অনুভূমিক প্রসারণ বেশি জরুরি। আলোর নিবিড়তা কমে যায় যদি গাছের বাইরের সবুজায়ন বা অঙ্গবিস্তার ভেতরের সবুজকে ছায়াচ্ছন্ন করে ফেলে।
অঙ্গবিস্তার ব্যবস্থাপনার কয়েকটি প্রাথমিক নীতি এইরকম —
১. আলোকের অধিকতম ব্যবহার
২. রোগ ও পোকার অস্তিত্ব ও আবাস রক্ষায় প্রয়োজনীয় অণু-জলবায়ু (Micro-climate)-কে রেওয়াত না করা।
৩. অন্তর্চাষের নানান প্রয়োজনে ডালপালাকে বিন্যস্ত করে দেওয়া।
৪. ফলন ও উৎকর্ষতা যতটা সম্ভব বাড়িয়ে তোলা।
৫. পল্লবসৌধের অর্থনীতি বজায় রাখা। ইত্যাদি।
(অধিক জানবার জন্য যোগাযোগ করুন ICAR-AICRP on Fruits, BCKV, Mohanpur -এর প্রকল্প আধিকারিকের সঙ্গে।)
——-ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।
Leave a Reply