কার্তিক মাসের চাষ

ডালশস্য

মুসুরঃ কার্তিক মাসে মুসুর বোনা যাবে। মুসুরের উন্নত জাতগুলি হল সুব্রত, মৈত্রী, শুভেন্দু, বি-৬২, বি-১৭৭, Hul-57 ইত্যাদি। বিঘায় ৪ কেজি বীজ দরকার হবে। ৩০x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে বুনলে ভালো। শেষ চাষের সময় জমিতে যথাক্রমে ৪, ৮ এবং ৮ কেজি হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ প্রয়োগ করতে হবে।

মটর : কার্তিক মাসে মটরের বীজও বোনা যাবে। ধূসর, জি.এফ.-৬৮, ডি.ডি.আর-২৩, রচনা শঙ্কর প্রভৃতি উন্নত জাত। বিঘায় সাড়ে ছয় কেজি বীজ লাগবে। ৩০x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে বুনতে হবে। শেষ চাষের সময় যথাক্রমে ৩, ৬ এবং ৬ কেজি হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।

খেসারি ঃ এই মাস খেসারি বোনার উপযুক্ত সময়। পায়রা ফসল রূপে ছোটো দানার জাত আর একক ফসল রূপে বড় দানার জাত বোনা হয়। একক ফসলের জন্য বিঘায় ৫.৫ থেকে ৮ কেজি হারে বীজ লাগবে আর পায়রা ফসলের জন্য ১১ থেকে ১৪ কেজি হারে বীজ দরকার হবে। ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে লাগানো ভাল, তার এক সপ্তাহ বাদে রাইজোবিয়াম জীবাণুসারের লেই মাখানো উচিত, প্রতি বিঘার জন্য ব্যবহৃত বীজে ২০০ গ্রাম জীবাণুসার লাগবে। বীজ সারি তে লাগালে ২৫-৩০x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে বুনতে হবে। নির্মল (বি-১), পুসা-১৪, প্রতীক, রতন (বায়ো এল-২১২), মহাতেওরা প্রভৃতি খেসারির উন্নত জাত। বিঘায় ২ কুইন্টালের সামান্য বেশি ফলন পাওয়া যায় তৈলবীজঃ
শ্বেত সরষে বা রেপসীড : কার্তিক মাসের প্রথমার্ধ শ্বেত সরষে বোনার সঠিক সময়। বিনয়, সুবিনয়, ঝুমকা ইত্যাদি ভালো জাত। বিঘায় ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি বীজ দরকার হবে। বীজ শোধন করে সারিতে বুনুন। সারিতে ৩০x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে বুনতে হবে।

রাই সরষেঃ সারাকার্তিক মাসজুড়েই রাই সরষে বোনা যাবে। অনেক সময় আশ্বিনের শেষ থেকেই বোনা শুরু হয়ে যায়। ভাগীরথী, সীতা, সরমা, বরুণা, পুসা বোল্ড, জে.ডি-৬, টি.এম.-৪, প্রভৃতি উন্নত জাত। অসেচ এলাকার জন্য সংযুক্তা জাতটি ব্যবহার করা যেতে পারে। বীজের হার শ্বেত সরষের মতই। প্রতি বর্গ মিটারে মোটামুটি ৩৫টি গাছ থাকবে। দেরীতে কাটা ধানের পর পরই সামান্য চাষ দিয়েও সরষে বোনা যেতে পারে। মই দিতে হবে বীজ ফেলার পর। পায়রা ফসল হিসাবেও সরষে বোনা যাবে ধান কাটার কয়েকদিন আগে। সেক্ষেত্রে বীজ ছিটিয়ে বুনতে হবে। জৈব ছত্রাকনাশক ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি প্রতি কেজি বীজের জন্য ৪ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করা ভালো; জীবাণুসার জমিতেও ছড়ানো যায়। সরষে চাষে সার লাগবে এই রকম ঃ জমি তৈরির সময় হেক্টরে (সাড়ে সাত বিঘে জমি) পাঁচ টন খোল, আড়াইশো কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট আর ২০ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। বীজ বোনার দুই সপ্তাহ, চার সপ্তাহ, ফুল আসার সময় অর্থাৎ সাত সপ্তাহ এবং দানা পুষ্ট হবার সময় অর্থাৎ ১১সপ্তাহ পরে সেচসহ (সেচ দেওয়ার দুদিন পর) চাপান সার হিসাবে হেক্টরে ৪০ কেজি ইউরিয়া আর ২০ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। সরষের জমিতে সাথি ফসল হিসাবে ছোলা, মুসুর, মেথি উপযুক্ত।


গোলাপ ঃ কার্তিক মাসে গোলাপ গাছে পাঁচটি পাঁচ মাসের সতেজ, রোগবিহীন ডাল রেখে বাকিগুলি ছেঁটে দিতে হবে। কাটা অংশে অতি অবশ্যই ব্লাইটক্স ছত্রাকনাশকের লেই লাগিয়ে দিন যাতে ডগা শুকনো রোগ বাডাই-ব্যাক রোগে আক্রান্ত না হয়। এরপর বর্গমিটার প্রতি পাঁচ কেজি জৈবসার, ৬৫ গ্রাম ইউরিয়া, দুশো গ্রাম করে খোল আর হাড়গুঁড়ো প্রয়োগ করুন। এই সার দেওয়ার আগে গোলাপ গোড়ার মাটি সরিয়ে খানিক রোদের সংস্পর্শে আনলে ফুলের গুণমান ও ফলন বাড়ে।


বেবিকর্ন : রবি মরশুমে বেবিকর্ন বোনার জন্য কার্তিকের দ্বিতীয়ার্ধ উপযুক্ত সময়। শীতকালীন বেবিকর্নের ফলন বেশি, নিচু জমিতেও চাষ করা চলে। ৭৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে রবিখন্দের বেবিকর্ন জমি থেকে উঠে আসে। বিঘা প্রতি খোসাবিহীন মোচার ফলন দুই থেকে সাড়ে তিন কুইন্টাল। এ রাজ্যের উপযোগী সংকর জাতগুলি হল প্রকাশ, এইচ এম ৪, হিম ১২৯, ভি এল ৪২ এবং সংমিশ্র জাত ভি এ এল বেবিকর্ন ১ ইত্যাদি। মূল ফসল বেবিকর্ন নিতে হলে প্রতি বিঘায় আঠারো হাজার গাছ থাকা উচিত। সারিতে গাছ লাগাতে হবে, দূরত্ব ৬০x১২.৫ সেন্টিমিটার। বীজ পাঁচ সেন্টিমিটার গভীরে না বসালে পাখিতে নষ্ট করবে। বীজ বোনার পর মালচিং করে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে। সাথী ফসল হিসাবে রবিখন্দে সরষে, মটর, পালং শাক, মেথিশাক, ধনে, লেটুস, মূলো, গাজর ইত্যাদি নেওয়া যায়। বেবিকর্ন যদি অপ্রধান ফসল হয় তবে সারির মধ্যে গাছের দূরত্ব দ্বিগুণ রাখতে হবে। বীজ বোনার আগে বীজ শোধন করতে কেজি প্রতি বীজে চার গ্রাম পরিমাণ ব্যাভিস্টিন মেশানো জরুরি। জমি তৈরির জন্য বিঘা প্রতি দেড় টন জৈবসার দিতে হবে। শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি সাড়ে বারো কেজি ইউরিয়া, পনেরো কেজি ডাই-এমোনিয়াম ফসফেট এবং ৯ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ লাগবে। বীজ বোনার পঞ্চাশ ও পঁয়ষট্টি দিন পর আরও দু’দফায় ঐ পরিমাণ ইউরিয়া চাপান দিতে হবে। ফুল আসার আগে অন্তত একটি সেচ (দুটি হলে আরও ভাল) এবং ফুল আসার সময় ও পরে আরও দুটি সেচ হলেই চলে।


স্ট্রবেরী : কার্তিক ও অঘ্রাণ মাসে সমতল এলাকায় স্ট্রবেরীর চারা লাগানো যায়; মাঘ মাসে ফুল ও ফল চলে আসে। স্ট্রবেরীর উন্নত জাতগুলি হল রেড কস্ট, ব্যাঙ্গালোর, সুইট চার্লি, পুসা আর্লি ডোয়ার্ফ ইত্যাদি। বিঘায় ১২ কুইন্টাল গোবর সার অথবা ৫ কুইন্টাল কেঁচোসার দিয়ে জমি ভালো করে চাষ দিতে হবে; শেষ চাষের সময় দিতে হবে ৩০ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট, ২০ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ এবং ৪ কেজি ক্যালসিয়াম নাইট্রেট। স্ট্রবেরী লাগানো হবে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু, এক মিটার চওড়া এবং প্রয়োজনানুগ লম্বা কেয়ারিতে। প্রতিটি কেয়ারিতে দুটি সারি রাখা যাবে, সারিতে চারার অন্তর থাকবে ৪৫ সেন্টিমিটার।


কুল : কার্তিক মাসে কুল গাছে পাউডারি মিলডিউ বা গুঁড়োচিতি রোগ লাগে; কচিপাতায় আক্রমণ শুরু হলেও ফলের গুটিতে ছড়ায়। আক্রান্ত ফল আর গুটি কালো হয়ে শুকিয়ে যায়, ছোটো অবস্থায় ঝরে পড়ে। তাই ফুল ফোটার আগে, ফোটার পর গুটি ধরার সময় প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম ৫০শতাংশ অথবা হেক্সাকোনাজল ৫ শতাংশ ওষুধ ০.৫ মিলিলিটার অথবা ট্রায়াডিমেফন ২৫শতাংশ ১গ্রাম স্প্রে করা দরকার।

—–ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *